`অসাম্য' অবশ্যম্ভাবী এটা মেনে নিয়েছি 

 

সংবাদ প্রতিদিন, জুলাই ১৯, ২০২০। 

 

 

ভারতে কোনও সেলেব বা তারকা তকমাপ্রাপ্ত কোভিড আক্রান্ত হলে যে পরিমাণ হইচই হচ্ছে তা অভাবিত পর্যায়ের। প্রার্থনা ও শুভকামনার স্রোত বয়েই চলেছে। কিন্তু সাধারণ কোভিড রোগীর প্রতি সাধারণ মানুষেরই আতঙ্ক, অশ্রদ্ধা ও বীতস্পৃহা দেখার মতো। অবাক লাগে, বিখ্যাত না হলে কি প্রার্থনা ও সমব্যথার ভাগ মেলে না! সামাজিক বয়কটের চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছেছি আমরা। মুখে বলছি, রোগের সঙ্গে লড়তে হবে, লড়ছি আদতে রোগীর সঙ্গে। এর কারণ কী? সংবাদ প্রতিদিনের তরফ থেকে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হয় আমাকে।

 

আমার উত্তর :

 

 

 

এই যে প্রবণতা, তার একটা সোজা ব্যাখ্যা আছে। দূরের জিনিসের প্রভাব আমাদের ওপর প্রত্যক্ষভাবে পড়ে না। তাই কোনও বিখ্যাত লোকের কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার খবরে আমাদের সহানুভূতি দেখাতে কোনও অসুবিধা নেই। বরং এতে বেশ একটা আলোচনা বা চর্চার আবহ তৈরি হয়। এই বিষয়টা নিয়ে প্রার্থনা ও শুভকামনা থেকে তির্যক মন্তব্য– এসবেরও একটা মনস্তাত্ত্বিক দিক আছে। কারণ, বিষয়টা ঘিরে আমাদের মনে নানা চিন্তা-আশঙ্কার বহিঃপ্রকাশের সুযোগ হয়।আবার, এর একটা সামাজিক দিক আছে। মানুষ সামাজিক জীব, তাই অন্যদের সঙ্গে এই সুযোগে চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি এসবের আদানপ্রদানের মাধ্যমে একটা সংযোগের সূত্র তৈরি হয়, একটা বৃহত্তর সমষ্টির অংশ হতে পেরে এক ধরনের আরাম বোধও হয়– নিজেদের ক্ষুদ্র গণ্ডির সমস্যার আলোচনায় যেটা হয় না। কিন্তু পাড়ায় কারও কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার খবরে যখন আমাদের নিজেদের প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তখন সমস্ত সহানুভূতি বা সমাজ সচেতনতা উবে গিয়ে পড়ে থাকে ‘চাচা আপন প্রাণ বঁাচা’ ধরনের অত্যন্ত স্বার্থকেন্দ্রিক মানসিকতা।

তবে, এই যে প্রবণতা, তার মধ্যে আরেকটা উপাদান হল ‘অসাম্য’– তা সে যতই অমানবিক হোক– সেটাকে অবশ্যম্ভাবী বলে মেনে নেওয়া, এমনকী সেই মেনে নেওয়াটাকে বাস্তববুদ্ধির পরিচয় হিসাবে ধরা ছাড়া উপায় কী এরকম ভাবা ! আসলে, সম্পদের অপ্রতুলতা এবং অসাম্যকে আমাদের জীবনে একটা স্বতঃসিদ্ধের মতো আমরা মেনে নিয়েছি– এরকমই তো হয়ে থাকে ভেবে। তার থেকেই আসে দরিদ্র ও অভাবী মানুষের কষ্টের প্রতি চরম উদাসীনতা। অনুষ্ঠানে দরদ দিয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বলতে পারো বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে?/ গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?’ আবৃত্তি করা এক ব্যাপার। আর, বাস্তব জীবনে এই চিন্তাধারার প্রয়োগ সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। তাই কোভিড-আক্রান্ত প্রতিবেশীকে ‘একঘরে’ করা বা গৃহ পরিচারিকাকে লকডাউনের সময় ছাড়িয়ে দেওয়া আর বিখ্যাত কারও কোভিড হলে প্রার্থনা ও সমব্যথার ঝড় তুলে দেওয়া – এই আচরণের মধ্যে যে চরম দ্বন্দ্ব আছে তা সম্পর্কে আত্মসচেতন না হওয়াটাই আসলে আমাদের জীবনযাপন ও ‘বিবেক’ নামক সমস্যাজনক মনন-অঙ্গটিকে স্বেচ্ছাপঙ্গু করে রাখার কৌশল।